ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাত দীর্ঘদিনের। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড নতুন মাত্রা পেয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গভীর উদ্বেগের কারণ হয়েছে। এই প্রতিবেদনে, এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত সংঘটিত ইসরায়েলি সামরিক অভিযান, ফিলিস্তিনি জনগণের উপর এর প্রভাব, এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক ইসরায়েলি সামরিক অভিযান
এপ্রিল ২০২৫-এ ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজা উপত্যকায় তাদের অভিযান সম্প্রসারণ করে। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন যে, "মোরাগ করিডোর" নামে একটি নতুন নিরাপত্তা করিডোর স্থাপন করা হবে, যা গাজা উপত্যকাকে বিভক্ত করবে এবং হামাসের উপর চাপ সৃষ্টি করবে। এই করিডোরটি পূর্বে অবস্থিত মোরাগ নামক ইসরায়েলি বসতির স্থানে স্থাপিত হচ্ছে, যা রাফাহ এবং খান ইউনিসের মধ্যে অবস্থিত।Wikipedia
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ নির্দেশ দেন যে, সামরিক বাহিনী গাজার আরও গভীরে প্রবেশ করবে এবং হামাসের হাতে আটক বন্দীদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে। এই অভিযানের ফলে গাজার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বোমাবর্ষণ ও গোলাবর্ষণ হয়, যার ফলে বহু ফিলিস্তিনি নিহত ও আহত হন।
ফিলিস্তিনি জনগণের উপর প্রভাব
ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের ফলে ফিলিস্তিনি জনগণ মারাত্মক মানবিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, সংঘাতের ফলে ৫০,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে অনেক নারী ও শিশু রয়েছেন। এছাড়াও, প্রায় ৯০% জনগণ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যা তাদের জীবনযাত্রাকে চরমভাবে প্রভাবিত করেছে।
মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো খাদ্য, পানি ও ওষুধের মারাত্মক সংকটের কথা জানিয়েছে। ইসরায়েলের অবরোধের ফলে এই সংকট আরও তীব্র হয়েছে, এবং গাজা প্রায় বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে।
সাংবাদিকদের উপর হামলা
ইসরায়েলি বাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযানে সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে, যা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করেছে। এপ্রিল ৭, ২০২৫-এ খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালের প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের ব্যবহৃত একটি তাঁবুতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ফিলিস্তিনি সাংবাদিক হেলমি আল-ফাকাওয়ি নিহত হন এবং নয়জন আহত হন। এই হামলায় আরও একজন সাংবাদিক আহমেদ মনসুর পরে মারা যান, যা সাংবাদিকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
ফিলিস্তিনি সাংবাদিক সমিতির মতে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি অভিযানে ২১০ জনের বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এই ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার আহ্বান জানানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া এসেছে। ফ্রান্স, মিশর এবং পশ্চিম তীরের নেতারা কায়রোতে এক সম্মেলনে যুদ্ধবিরতি পুনরায় শুরু করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছেন। তবে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাতে গাজা নিয়ন্ত্রণ ও সেখানকার জনগণকে স্থানান্তরের পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানান।
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের ফলে সৃষ্ট মানবিক সংকটের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। তবে, ইসরায়েলি সরকার হামাসের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান বজায় রেখেছে এবং সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযান ফিলিস্তিনি জনগণের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের কারণ হয়েছে। মানবিক সংকট, সাংবাদিকদের উপর হামলা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে, এই সংঘাতের সমাধানের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জরুরি হয়ে উঠেছে।
হামলার প্রেক্ষাপটে মুসলিমদের করণীয় কাজ
বর্তমানে ফিলিস্তিনের নিরীহ জনগণের উপর ইসরাইলের চলমান নিষ্ঠুর ও অমানবিক হামলা গোটা মুসলিম বিশ্বকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। শিশু, নারী ও সাধারণ মানুষ যখন বর্বর হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছে, তখন একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের করণীয় কী, তা জানা ও পালন করা একান্ত জরুরি।
করণীয়সমূহ:
১. দোয়া ও ইবাদতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা:
আল্লাহই চূড়ান্ত সাহায্যকারী। তাই মুসলিম উম্মাহর উচিত ফিলিস্তিনের মুসলমানদের জন্য দোয়া করা, কুরআন তিলাওয়াত ও ইস্তিগফার করা এবং কিয়ামুল লাইল, দোহার নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। রাসূল (সা.) বলেছেন, “দোয়া মুমিনের হাতিয়ার”।
২. মানবিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান:
যেখানে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে অংশগ্রহণ সম্ভব নয়, সেখানে অর্থনৈতিক সহায়তা ও ত্রাণসামগ্রী প্রেরণ করা মুসলিমদের অন্যতম দায়িত্ব। বিশ্বস্ত সংস্থার মাধ্যমে খাদ্য, ওষুধ, পানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পাঠানো উচিত।
৩. তথ্য প্রচার ও জনমত গঠন:
ইসরাইলের নির্মমতা ও ফিলিস্তিনিদের দুরবস্থার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে হবে মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া ও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। এর মাধ্যমে বিশ্ববাসীর মধ্যে সচেতনতা গড়ে উঠবে এবং আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
৪. পণ্য বয়কট ও অর্থনৈতিক প্রতিরোধ:
ইসরাইল-সমর্থিত কোম্পানি ও তাদের পণ্য বর্জন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যকর পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ তাদের আর্থিক সক্ষমতা দুর্বল করতে সাহায্য করতে পারে।
৫. ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা:
মুসলিম উম্মাহর মধ্যে দলাদলি ও বিভক্তি না রেখে একটি কণ্ঠে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি। আল্লাহ কুরআনে বলেন:
“তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পরে বিভেদ সৃষ্টি করো না” (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)।
৬. ন্যায়বিচারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া:
যে কোনো জাতি, ধর্ম বা গোষ্ঠীর মানুষের উপর অন্যায় হলে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ইসলামি নীতিমালার অংশ। মুসলমান হিসেবে আমাদের কণ্ঠ উচ্চ করা উচিত—যেখানেই জুলুম, সেখানেই প্রতিবাদ।
৭. ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস ও চেতনা শিক্ষা দেওয়া:
ফিলিস্তিনের ইতিহাস, মুসলিমদের ভূমিকা, আল-আকসা মসজিদের গুরুত্ব—এসব বিষয়ে নতুন প্রজন্মকে সচেতন করতে হবে, যাতে তারা মুসলিম উম্মাহর প্রতি দায়িত্বশীল হতে শেখে।
ইসরাইলের নিষ্ঠুর হামলার সময় আমাদের শুধু আবেগ নয়, কৌশলী ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ঈমান, একতা, দোয়া, সচেতনতা ও সাহায্যের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারে। আল্লাহ যেন আমাদের ফিলিস্তিনের ভাই-বোনদের পাশে দাঁড়ানোর তাওফিক দেন, এবং তাঁদের বিজয় দান করেন—এই প্রার্থনা করি।